হরিলক্ষ্মী
১ পরিচ্ছেদ
বেলপুর তালুকটুকু বড় ব্যাপার নয়। উঠিতে বসিতে প্রজা ঠেঙ্গাইয়া হাজার-বারোর উপরে উঠে না, কিন্ত সাড়ে পোনর আনার অংশীদার শিবচরণের কাছে দুপাই অংশের বিপিনবিহারীকে যদি জাহাজের সঙ্গে জেলে-ডিঙ্গীর তুলনাই করিয়া থাকি ত বোধ করি, অতিশয়োক্তির অপরাধ করি নাই!
যাহা লইয়া এই গল্পের উৎপত্তি, তাহা ছোট, তথাপি এই ছোট ব্যাপারটুকু অবলম্বন করিয়া হরিলক্ষ্মীর জীবনে যাহা ঘটিয়া গেল, তাহা ক্ষুদ্রও নহে, তুচ্ছও নহে। সংসারে এমনই হয়। বেলপুরের দুই সরিক, শান্ত নদীকূলে জাহাজের পাশে জেলে-ডিঙ্গীর মত একটি অপরটির পার্শ্বে নিরুপদ্রবেই বাঁধা ছিল, আকস্মাৎ কোথাকার একটা উড়ো ঝড়ে তরঙ্গ তুলিয়া জাহাজের দড়ি কাটিল, নোঙ্গর ছিঁড়িল, এক মুহূর্ত্তে ক্ষুদ্র তরণী কি করিয়া যে বিধ্বস্ত হইয়া গেল, তাহার হিসাব পাওয়াই গেল না।
দূর হইলেও জ্ঞাতি এবং ছয়-সাত পুরুষ পূর্ব্বে ভদ্রাসন উভয়ের একত্রই ছিল, কিন্ত আজ একজনের ত্রিতল অট্টালিকা গ্রামের মাথায় চড়িয়াছে এবং অপরের জীর্ণ গৃহ দিনের পর দিন ভূমিশয্যা গ্রহণের দিকেই মনোনিবেশ করিয়াছে।
তবু এমনই ভাবে দিন কাটিতেছিল এবং এমন করিয়া ত বাকী দিনগুলা বিপিনের সুখ-দুঃখে নির্ব্বিবাদে কাটিতে পারিত; কিন্তু যে মেঘখণ্ডটুকু উপলক্ষ করিয়া অকালে ঝঞ্ঝা উঠিয়া সমস্ত বিপর্যস্ত করিয়া দিল তাহা এইরূপ।
সাড়ে পোনর আনার অংশীদার শিবচরণের হঠাৎ পত্নীবিয়োগ ঘটিলে বন্ধুরা কহিলেন, চল্লিশ একচল্লিশ কি আবার একটা বয়স! তুমি আবার বিবাহ কর। শত্রুপক্ষীয়রা শুনিয়া হাসিল; কহিল, চল্লিশ ত শিবচরণের চল্লিশ বছর আগে পার হয়ে গেছে! অর্থাৎ কোনটাই সত্য নয়। আসল কথা, বড়বাবুর দিব্য গৌরবর্ণ নাদুস-নুদুস দেহ, সুপুষ্ট মুখের পরে রোমের চিহ্নমাত্র নাই। যথাকালে দাড়ি-গোঁফ না গজানোর সুবিধা হয় ত কিছু আছে, কিন্তু অসুবিধাও বিস্তর। বয়স আন্দাজ করা ব্যাপারে যাহারা নিচের দিকে যাইতে চাহে না, উপরের দিকে তাহারা যে অঙ্কের কোন্ কোঠায় গিয়া ভর দিয়া দাঁড়াইবে, তাহা নিজেরাই ঠাহর করিতে পারে না। সে যাই হোক, অর্থশালী পুরুষের যে কোন দেশেই বয়সের অজুহাতে বিবাহ আটকায় না, বাঙ্গালা দেশ ত নয়-ই। মাস-দেড়েক শোক-তাপ ও না না করিয়া গেল, তাহার পরে হরিলক্ষ্মীকে বিবাহ করিয়া শিবচরণ বাড়ি আনিলেন। শূন্য গৃহ এক দিনেই ষোলকলায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। কারণ শত্রুপক্ষ যাহাই কেন না বলুক, প্রজাপতি যে সত্যই তাঁহার প্রতি এবার অতিশয় প্রসন্ন ছিলেন, তাহা মানিতেই হইবে। তাহারা গোপনে বলাবলি করিল, পাত্রের তুলনায় নববধূ বয়সের দিক দিয়ে একেবারেই বে-মানান হয় নাই, তবে একটি ছেলে-মেয়ে সঙ্গে লইয়া ঘরে ঢুকিলে আর খুঁত ধরিবার কিছু থাকিত না! তবে সে যে সুন্দরী, এ কথা তাহারা স্বীকার করিল। ফল কথা সচরাচর বড় বয়সের চেয়েও লক্ষ্মীর বয়সটা কিছু বেশি হইয়া গিয়াছিল, বোধ করি, উনিশের কম হইবে না। তাহার পিতা আধুনিক নব্যতন্ত্রের লোক, যত্ন করিয়া মেয়েকে বেশি পর্য্যন্ত শিক্ষা দিয়া ম্যাট্রীক পাশ করাইয়াছিলেন; তাঁহার অন্য ইচ্ছা ছিল, শুধু ব্যবস ফেল পড়িয়া আকস্মিক দারিদ্র্যের জন্যই এই সুপাত্রে কন্যা অর্পণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
লক্ষ্মী সহরের মেয়ে, স্বামীকে দুই-চারি দিনেই চিনিয়া ফেলিল। তাহার মুস্কিল হইল এই যে, আত্মীয় মিশ্রিত বহু পরিজন পরিবৃত বৃহৎ সংসারের মধ্যে সে মন খুলিয়া কাহারও সহিত মিশিতে পারিল না। ওদিকে শিবচরণের ভালবাসার ত আর অন্ত রহিল না। শুধু কেবল বৃদ্ধের তরুণী ভার্য্যা বলিয়াই নয়, সে যেন একেবারে অমূ্ল্য নিধি লাভ করিল। বাটীর আত্মীয় আত্মীয়ার দল কোথায় কি করিয়া যে তাহার মন যোগাইবে, খুঁজিয়া পাইল না। একটা কথা সে প্রায়ই শুনিতে পাইত—এইবার মেজবৌয়ের মুখে কালি পড়িল। কি রূপে, কি গুণে, কি বিদ্যা-বুদ্ধিতে এত দিলে তাহার গর্ব্ব খর্ব্ব হইল।
কিন্তু এত করিয়াও সুবিধা হইল না, মাস-দুয়েকের মধ্যে লক্ষ্মী অসুখে পড়িল। এই অসুখের মধ্যেই এক দিন মেজবৌয়ের সাক্ষাৎ মিলিল। তিনি বিপিনের স্ত্রী, বড়বাড়ির নূতন বধূর জ্বর শুনিয়া দেখিতে আসিয়াছিলেন। বয়সে বোধ হয় দুই-তিন বছরের বড়; তিনি যে সুন্দরী, তাহা মনে মনে লক্ষ্মী স্বীকার করিল। কিন্তু এই বয়সেই দারিদ্র্যের ভীষণ কশাঘাতের চিহ্ন তাঁহার সব্বাঙ্গে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে বছর-ছয়েকের একটি ছেলে, সে-ও রোগা। লক্ষ্মী শয্যার একধারে সযত্নে বসিতে স্থান দিয়া ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল। হাতে কয়েকগাছি সোণার চুড়ি ছাড়া আর কোন অলঙ্কার নাই, পরণে ঈষৎ মলিন একখানি রাঙা পাড়ের ধুতি, বোধ হয়, তাহার স্বামীর হইবে, পল্লীগ্রামের প্রথামত ছেলেটি দিগম্বর নয়, তাহারও কোমরে একখানি শিউলীফুলে ছাপানো ছোট কাপড় জড়ানো।
লক্ষ্মী তাহার হাতখানি টানিয়া লইয়া আস্তে আস্তে বলিল, ভাগ্যে জ্বর হয়েছিল, তাই ত আপনার দেখা পেলুম! কিন্তু সম্পর্কে আমি বড় জা হই মেজবৌ। শুনেছি, মেজঠাকুরণ এঁর চেয়ে ঢের ছোট।
মেজবৌ হাসিমুখে কহিল, সম্পর্কে ছোট হ’লে কি তাকে আপনি বলে?
লক্ষ্মী কহিল, প্রথম দিন এই যা বললুম, নইলে আপনি বলবার লোক আমি নই। কিন্তু তাই ব’লে তুমিও যেন আমাকে দিদি বলে ডেকো না—ও আমি সইতে পারব না। আমার নাম লক্ষ্মী।
মেজবৌ কহিল, নামটি ব’লে দিতে হয় না দিদি, আপনাকে দেখলেই জানা যায়। আর আমার নাম—কি জানি, কে যে ঠাট্টা ক’রে কমলা রেখেছিলেন—এই বলিয়া সে সকৌতুকে একটুখানি হাসিল মাত্র।
হরিলক্ষ্মীর ইচ্ছা করিল, সে-ও প্রতিবাদ করিয়া বলে তোমার পানে তাকালেও তোমার নামটি বুঝা যায়, কিন্তু অনুকৃতির মত শুনাইবার ভয়ে বলিতে পারিল না; কহিল, আমাদের নামের মানে এক। কিন্তু মেজবৌ, আমি তোমাকে তুমি বল্তে পার্লুম, তুমি পার্লে না। মেজবৌ সহাস্যে জবাব দিল, হঠাৎ না-ই পারলুম দিদি! এক বয়স ছাড়া আপনি সকল বিষয়েই আমার বড়। যাক্ না দুদিন—দরকার হ’লে বদ্লে নিতে কতক্ষণ?
হরিলক্ষ্মীর মুখে সহসা ইহার প্রত্যুত্তর জোগাইল না, কিন্তু সে মনে বুঝিল, এই মেয়েটি প্রথম দিনের পরিচয়টিকে মাখামাখিতে পরিণত করিতে চাহে না। কিন্তু কিছু একটা বলিবার পূর্ব্বেই মেজবৌ উঠিবার উপক্রম করিয়া কহিল, এখন তাহলে উঠি দিদি, কাল আবার—
লক্ষী বিস্ময়াপন্ন হইয়া বলিল, এখনই যাবে কি রকম, একটু ব’সো!
মেজবৌ কহিল, আপনি হুকুম কর্লে ত বস্তেই হবে, কিন্তু আজ যাই দিদি, ওঁর আসবার সময় হল। এই বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং ছেলের হাত ধরিয়া যাইবার পূর্ব্বে সহাস্যবদনে কহিল, আসি দিদি। কাল একটু সকাল সকাল আস্বো, কেমন? বলিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
বিপিনের স্ত্রী চলিয়া গেলে হরিলক্ষ্মী সেই দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রইল। এখন জ্বর ছিল না, কিন্তু গ্লানি ছিল। তথাপি কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত সে ভুলিয়া গেল। এত দিন গ্রাম ঝেঁটাইয়া কত বৌ-ঝি যে আসিয়াছে, তাহার সংখ্যা নাই, কিন্তু পাশের বাড়ির দরিদ্র ঘরের এই বধূর সহিত তাহাদের তুলনাই হয় না। তাহারা যাচিয়া আসিয়াছে, উঠিতে চাহে নাই। আর বসিতে বলিলে ত কথাই নাই। সে কত প্রগল্ভতা, কত বাঁচালতা, মনোরঞ্জন করিবার কত কি লজ্জাকর প্রয়াস! ভারাক্রান্ত মন তাহার মাঝে মাঝে বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু ইহাদেরই মধ্য হইতে অকস্মাৎ কে আসিয়া তাহার রোগশয্যায় মুহূর্ত্ত-কয়েকের তরে নিজের পরিচয় দিয়া গেল। তাহার বাপের বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করিবার সময় হয় নাই, কিন্তু প্রশ্ন না করিয়াও লক্ষ্মী কি জানি কেমন করিয়া অনুভব করিল—তাহার মত সে কিছুতেই কলিকাতার মেয়ে নয়। পল্লী অঞ্চলে লেখাপড়া জানে বলিয়া বিপিনের স্ত্রীর একটা খ্যাতি আছে। লক্ষ্মী ভাবিল, খুব সম্ভব বৌটি সুর করিয়া রামায়ণ মহাভারত পড়িতে পারে, কিন্তু তাহার বেশি নহে। যে পিতা বিপিনের মত দীন দুঃখীর হাতে মেয়ে দিয়াছে, সে কিছু আর মাষ্টার রাখিয়া স্কুলে পড়াইয়া পাস করাইয়া কন্যা সম্প্রদান করে নাই। উজ্জ্বল শ্যাম—ফর্সা বলা চলে না। কিন্তু রূপের কথা ছাড়িয়া দিয়াও, শিক্ষা, সংসর্গ, অবস্থা কিছুতেই ত বিপিনের স্ত্রী তাহার কাছে দাঁড়াইতে পারে না। কিন্তু একটা ব্যাপারে লক্ষ্মীর নিজেকে যেন ছোট মনে হইল। তাহার কণ্ঠস্বর—সে যেন গানের মত, আর বলিবার ধরনটি একেবারে মধু দিয়া ভরা। এতটুকু জড়িমা নাই, কথাগুলি যেন সে বাড়ি হইতে কণ্ঠস্থ করিয়া আসিয়াছিল, এমনই সহজ। কিন্তু সব চেয়ে যে বস্তু তাহাকে বেশি বিদ্ধ করিল, সে ওই মেয়েটির দূরত্ব। সে যে দরিদ্র ঘরের বধূ, তাহা মুখে না বলিয়াও এমন করিয়াই প্রকাশ করিল, যেন ইহাই তাহার স্বাভাবিক, যেন এ ছাড়া আর কিছু তাহাকে কোনমতেই মানাইত না। দরিদ্র, কিন্তু কাঙাল নয়। এক পরিবারের বধূ একজনের পীড়ায় আর একজন তাহার তত্ত্ব লইতে আসিয়াছে—ইহার অতিরিক্ত লেশমাত্রও অন্য উদ্দেশ্য নাই। সন্ধ্যার পরে স্বামী দেখিতে আসিলে হরিলক্ষ্মী নানা কথার পরে কহিল, আজ ও-বাড়ীর মেজবৌ-ঠাকরুণকে দেখলাম।
শিবচরণ কহিল, কাকে? বিপিনের বৌকে?
লক্ষ্মী কহিল, হাঁ। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন, এতকাল পরে আমাকে নিজেই দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু মিনিট-পাঁচেকের বেশি বসতে পারলেন না, কাজ আছে ব’লে উঠে গেলেন ।
শিবচরণ কহিল, কাজ? আরে, ওদের দাসী আছে না চাকর আছে? বাসন-মাজা থেকে হাঁড়ি-ঠেলা পর্য্যন্ত—কই, তোমার মত শুয়ে ব’সে গায়ে ফুঁ দিয়ে কাটাক্ ত দেখি? এক ঘটি জল পর্য্যন্ত আর তোমাকে গড়িয়ে খেতে হয় না।
নিজের সম্বন্ধে এইরূপ মন্তব্য হরিলক্ষ্মীর অত্যন্ত খারাপ লাগিল, কিন্তু কথাগুলা নাকি তাহাকে বাড়াইবার জন্যই, লাঞ্ছনার জন্য নহে, এই মনে করিয়া সে রাগ করিল না, বলিল, শুনেছি নাকি মেজবৌর বড় গুমোর, বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায় না?
শিবচরণ কহিল, যাবে কোত্থেকে? হাতে কগাছি চুড়ি ছাড়া আর ছাইও নেই—লজ্জায় মুখ দেখাতে পারে না।
হরিলক্ষ্মী একটুখানি হাসিয়া বলিল, লজ্জা কিসের? দেশের লোক কি ওঁর গায়ে জড়োয়া গয়না দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, না, দেখতে না পেলে ছি ছি করে?
শিবচরণ কহিল, জড়োয়া গহনা! আমি যা তোমাকে দিয়েছি, কোন্ শালার বেটা তা চোখে দেখেছে? পরিবারকে আজ পর্য্যন্ত দুগাছা চুড়ি ছাড়া আর গড়িয়ে দিতে পার্লি নে! বাবা! টাকার জোর বড় জোর! জুতো মারব আর—
হরিলক্ষ্মী ক্ষুণ্ণ ও অতিশয় লজ্জিত হইয়া বলিল, ছি ছি, ও-সব তুমি কি বল্ছ?
শিবচরণ কহিল, না না, আমার কাছে লুকোছাপা নেই—যা বল্ব, তা স্পষ্টাস্পষ্টি কথা।
হরিলক্ষ্মী নিরুত্তরে চোখ বুজিয়া শুইল। বলবারই বা আছে কি? ইহারা দুর্ব্বলের বিরুদ্ধে অত্যন্ত রূঢ় কথা কঠোর ও কর্কশ করিয়া উচ্চারণ করাকেই একমাত্র স্পষ্টবাদিতা বলিয়া জানে। শিবচরণ শান্ত হইল না, বলিতে লাগিল, বিয়েতে যে পাঁচশ টাকা ধার নিয়ে গেলি, সুদে-আসলে সাত-আটশ হয়েছে, তা খেয়াল আছে? গরীব একধারে প’ড়ে আছিস্ থাক্, ইচ্ছে কর্লে যে কান ম’লে দূর ক’রে দিতে পারি। দাসীর যোগ্য নয়—আমার পরিবারের কাছে গুমোর।
হরিলক্ষ্মী পাশ ফিরিয়া শুইল। অসুখের উপর বিরক্তি ও লজ্জায় তাহার সর্ব্বশরীর যেন ঝিম ঝিম করিতে লাগিল।
পরদিন দুপুর-বেলায় ঘরের মধ্যে মৃদুশব্দে হরিলক্ষ্মী চোখ চাহিয়া দেখিল, বিপিনের স্ত্রী বাহির হইয়া যাইতেছে। ডাকিয়া কহিল, মেজবৌ, চলে যাচ্চো যে?
মেজবৌ সলজ্জে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আমি ভেবেছিলাম, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আজ কেমন আছেন দিদি?
হরিলক্ষ্মী কহিল, আজ ঢের ভাল আছি, কই তোমার ছেলেকে আনো নি?
মেজবৌ বলিল, আজ সে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লো দিদি।
হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়্লো মানে কি?
অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে ব’লে আমি দিনের-বেলায় বড় তাকে ঘুমোতে দিই নে দিদি।
হরিলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিল, রোদে রোদে দুরন্তপনা ক’রে বেড়ায় না?
মেজবৌ কহিল, করে বই কি। কিন্তু ঘুমোনোর চেয়ে সে বরঞ্চ ভাল।
তুমি নিজে বুঝি কখনো ঘুমোও না?
মেজবৌ হাসিমুখে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।
হরিলক্ষ্মী ভাবিয়াছিল, মেয়েদের স্বভাবের মত এবার হয় ত সে তাহার অনবকাশের দীর্ঘ তালিকা দিতে বসিবে, কিন্তু সে সেরূপ কিছুই করিল না। ইহার পরে অন্যান্য কথাবার্ত্তা চলিতে লাগিল। কথায় কথায় হরিলক্ষ্মী তাহার বাপের বাড়ির কথা, ভাই-বোনের কথা, মাষ্টারমশায়ের কথা, স্কুলের কথা, এমন কি তাহার ম্যাট্রিক পাস করার কথাও গল্প করিয়া ফেলিল। অনেকক্ষণ পরে যখন হুঁস হইল, তখন স্পষ্ট দেখিতে পাইল, শ্রোতা হিসাবে মেজবৌ যত ভালই হোক, বক্তা হিসাবে একেবারে অকিঞ্চিৎকর। নিজের কথা সে প্রায় কিছুই বলে নাই। প্রথমটা লক্ষ্মী লজ্জা বোধ করিল, কিন্তু তখনই মনে করিল, আমার কাছে গল্প করিবার মত তাহার আছেই বা কি! কিন্তু কাল যেমন এই বধূটির বিরুদ্ধে মন তাহার অপ্রসন্ন হইয়া উঠিয়াছিল, আজ তেমনই ভারি একটা তৃপ্তি বোধ করিল।
দেয়ালের মূল্যবান ঘড়িতে নানাবিধ বাজনা-বাদ্য করিয়া তিনটা বাজিল। মেজবৌ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সবিনয়ে কহিল, দিদি, আজ তা হ’লে আসি?
লক্ষ্মী সকৌতুকে বলিল, তোমার বুঝি ভাই তিনটে পর্য্যন্তই ছুটি? ঠাকুরপো নাকি কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি মিলিয়ে বাড়ি ঢোকেন?
মেজবৌ কহিল, আজ তিনি বাড়িতে আছেন।
আজ কেন তবে আর একটু ব’সো না?
মেজবৌ বসিল না, কিন্তু যাবার জন্যও পা বাড়াইল না। আস্তে আস্তে বলিল, দিদি, আপনার কত শিক্ষা-দীক্ষা, কত লেখা-পড়া, আমি পাড়াগাঁয়ের—
তোমার বাপের বাড়ি বুঝি পাড়াগাঁয়ে?
হাঁ দিদি, সে একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ে। না বুঝে কাল হয় ত কি বল্তে কি ব’লে ফেলেছি, কিন্তু অসম্মান করার জন্যে—আপনি যে দিব্যি করতে বল্বেন, দিদি—
হরিলক্ষ্মী আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, সে কি মেজবৌ, তুমি ত আমাকে এমন কথাই বল নি!
মেজবৌ এ কথার প্রত্যুত্তরে আর একটা কথাও কহিল না। কিন্তু ‘আসি’ বলিয়া পুনশ্চ বিদায় লইয়া যখন সে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল, তখন কণ্ঠস্বর যেন তাহার অকস্মাৎ আর এক রকম শুনাইল।
রাত্রিতে শিবচরণ যখন কক্ষে প্রবেশ করিলেন, তখন হরিলক্ষ্মী চুপ করিয়া শুইয়া ছিল, মেজবৌয়ের শেষের কথাগুলা আর তাহার স্মরণ ছিল না। দেহ অপেক্ষাকৃত সুস্থ, মনও শান্ত, প্রসন্ন ছিল।
শিবচরণ জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছ বড়বৌ ?
লক্ষ্মী উঠিয়া বসিয়া কহিল, ভাল আছি।
শিবচরণ কহিল, সকালের ব্যাপার জান ত? বাছাধনকে ডাকিয়ে এনে সক্কলের সাম্নে এম্নি কড়কে দিয়েছি যে, জন্মে ভুল্বে না। আমি বেলপুরের শিবচরণ! হাঁ !
হরিলক্ষ্মী ভীত হইয়া কহিল, কাকে গো ?
শিবচরণ কহিল, বিপ্নেকে। ডেকে বলে দিলাম, তোমার পরিবার আমার পরিবারের কাছে জাঁক করে তাকে অপমান ক’রে যায়, এত বড় আস্পর্দ্ধা ! পাজী, নচ্ছার, ছোটলোকের মেয়ে! তার ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢেলে গাধায় চড়িয়ে গাঁয়ের বার ক’রে দিতে পারি জানিস্?
হরিলক্ষ্মীর রোগক্লিষ্ট মুখ একেবারে ফ্যাঁকাশে হইয়া গেল—বল কি গো?
শিবচরণ নিজের বুকে তাল ঠুকিয়া সদর্পে বলিতে লাগিল, এ গাঁয়ে জজ বল, ম্যাজিষ্ট্রেট বল, আর দারোগা পুলিস বল, সব এই শর্ম্মা! এই শর্ম্মা! মরণ-কাঠি, জীয়ন-কাঠি এই হাতে। তুমি বল, কাল যদি না বিপ্নের বৌ এসে তোমার পা টেপে ত আমি লাটু চৌধুরীর ছেলেই নই! আমি—
বিপিনের বধূকে সর্ব্বসমক্ষে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করিবার বিবরণ ও ব্যাখ্যায় লাটু চৌধুরীর ছেলে অ-কথা কু-কথার আর শেষ রাখিল না। আর তাহারই সম্মুখে স্তব্ধ নির্নিমেষ চক্ষুতে চাহিয়া হরিলক্ষ্মীর মনে হইতে লাগিল, ধরিত্রী, দ্বিধা হও!
২ পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পক্ষের তরুণী ভার্য্যার দেহরক্ষার জন্য শিবচরণ কেবলমাত্র নিজের দেহ ভিন্ন আর সমস্তই দিতে পারিত। হরিলক্ষ্মীর সেই দেহ বেলপুরে সারিতে চাহিল না। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন হাওয়া বদলাইবার। শিবচরণ সাড়ে পোনর আনার মর্য্যাদা মত ঘটা করিয়া হাওয়া বদলানোর আয়োজন করিল। যাত্রার শুভদিনে গ্রামের লোক ভাঙ্গিয়া পড়িল, আসিল না কেবল বিপিন ও তাহার স্ত্রী। বাহিরে শিবচরণ যাহা না বলিবার, তাহা বলিতে লাগিল এবং ভিতরে বড়পিসি উদ্দাম হইয়া উঠিলেন। বাহিরেও ধূয়া ধরিবার লোকাভাব ঘটিল না, অন্তঃপুরেও তেমনই পিসীমার চীৎকারের আয়তন বাড়াইতে যথেষ্ট স্ত্রীলোক জুটিল। কিছুই বলিল না শুধু হরিলক্ষ্মী। মেজবৌয়ের প্রতি তাহার ক্ষোভ ও অভিমানের মাত্রা কাহারও অপেক্ষাই কম ছিল না, সে মনে মনে বলিতে লাগিল, তাহার বর্ব্বর স্বামী যত অন্যায়ই করিয়া থাক, সে নিজে ত কিছু করে নাই, কিন্তু ঘরের ও বাহিরের যে সব মেয়েরা আজ চেঁচাইতেছিল, তাহাদের সহিত কোন সূত্রেই কণ্ঠ মিলাইতে তাহার ঘৃণা বোধ হইল। যাইবার পথে পাল্কীর দরজা ফাঁক করিয়া লক্ষ্মী উৎসুক চক্ষুতে বিপিনের জীর্ণ গৃহের জানালার প্রতি চাহিয়া রহিল, কিন্তু কাহারও ছায়াটুকুও তাহার চোখে পড়িল না।
কাশীতে বাড়ি ঠিক করা হইয়াছিল, তথাকার জল-বাতাসের গুণে নষ্ট স্বাস্থ্য ফিরিয়া পাইতে লক্ষ্মীর বিলম্ব হইল না, মাস-চারেক পরে যখন সে ফিরিয়া আসিল, তাহার দেহের কান্তি দেখিয়া মেয়েদের গোপন ঈর্ষার অবধি রহিল না।
হিম-ঋতু আগতপ্রায়, দুপুর-বেলায় মেজবৌ চিররুগ্ন স্বামীর জন্য একটা পশমের গলাবন্ধ বুনিতেছিল, অনতিদূরে বসিয়া ছেলে খেলা করিতেছিল, সে-ই দেখিতে পাইয়া কলরব করিয়া উঠিল, মা, জ্যাঠাইমা।
মা হাতের কাজ ফেলিয়া তাড়াতাড়ি একটা নমস্কার করিয়া লইয়া আসন পাতিয়া দিল; স্মিতমুখে প্রশ্ন করিল, শরীর নিরাময় হয়েছে দিদি ?
লক্ষ্মী কহিল, হাঁ, হয়েছে। কিন্তু না হতেও পারতো, না ফিরতেও পারতাম, অথচ যাবার সময়ে একটিবার খোঁজও নিলে না। সমস্ত পথটা তোমার জানালার পানে চেয়ে চেয়ে গেলাম, একবার ছায়াটুকুও চোখে পড়ল না। রোগা বোন চ’লে যাচ্ছে, একটুখানি মায়াও কি হ’ল না মেজবৌ? এম্নি পাষাণ তুমি?
মেজবৌয়ের চোখ ছল্ ছল্ করিয়া আসিল, কিন্তু সে কোন উত্তরই দিল না।
লক্ষ্মী বলিল, আমার আর যা দোষই থাক মেজবৌ, তোমার মত কঠিন প্রাণ আমার নয়। ভগবান না করুন, কিন্তু অমন সময়ে আমি তোমাকে না দেখে থাক্তে পারতাম না।
মেজবৌ এ অভিযোগেরও কোন জবাব দিল না, নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল।
লক্ষ্মী আর কখনও আসে নাই, আজ এই প্রথম এ বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছে। ঘরগুলি ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিয়া বেড়াইতে লাগিল। শতবর্ষের জরাজীর্ণ গৃহ, মাত্র তিনখানি কক্ষ কোনমতে বাসোপযোগী রহিয়াছে। দরিদ্রের আবাস, আসবাব-পত্র নাই বলিলেই চলে, ঘরের চূণ-বালি খসিয়াছে, সংস্কার করিবার সামর্থ্য নাই, তথাপি অনাবশ্যক অপরিচ্ছন্নতা এতটুকু কোথাও নাই। স্বল্প বিছানা ঝর্ ঝর্ করিতেছে, দুই-চারি খানি দেব-দেবীর ছবি টাঙানো আছে, আর আছে মেজবৌয়ের হাতের নানাবিধ শিল্পকর্ম্ম। অধিকাংশই পশম ও সূতার কাজ, তাহা শিক্ষানবীশের হাতের লাল ঠোঁটওয়ালা সবুজ রঙের টিয়াপাখী অথবা পাঁচরঙা বেরালের মূর্ত্তি নয়। মূল্যবান ফ্রেমে আঁটা লাল-নীল-বেগুনি-ধূসর-পাঁশুটে নানা বিচিত্র রঙের সমাবেশে পশমে বোনা ‘ওয়েল-কম্’ ‘আসুন বসুন” অথবা বানান-ভুল গীতার শ্লোকার্দ্ধও নয়। লক্ষ্মী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, ওটি কার ছবি মেজবৌ, যেন চেনা চেনা ঠেক্ছে।
মেজবৌ সলজ্জে হাসিয়া কহিল, ওটি তিলক মহারাজের ছবি দেখে বোনবার চেষ্টা করেছিলাম দিদি, কিন্তু কিছুই হয় নি। এই কথা বলিয়া সে সম্মুখের দেয়ালে টাঙানো ভারতের কৌস্তুভ, মহাবীর তিলকের ছবি আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিল।
লক্ষ্মী বহুক্ষণ সেইদিকে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, চিন্তে পারি নি, সে আমারই দোষ মেজবৌ, তোমার নয়। আমাকে শেখাবে ভাই ? এ বিদ্যে শিখতে যদি পারি ত তোমাকে গুরু ব’লে মানতে আমার আপত্তি নেই।
মেজবৌ হাসিতে লাগিল। সে দিন ঘণ্টা তিন-চার পরে বিকালে যখন লক্ষ্মী বাড়ি ফিরিয়া গেল, তখন এই কথাই স্থির করিয়া গেল যে, কলা-শিল্প শিখিতে কাল হইতে সে প্রত্যহ আসিবে।
আসিতেও লাগিল, কিন্তু দশ-পনেরো দিনেই স্পষ্ট বুঝিতে পারিল, এ বিদ্যা শুধু কঠিন নয়, অর্জ্জন করিতেও সুদীর্ঘ সময় লাগিবে। এক দিন লক্ষ্মী কহিল, কই মেজবৌ, তুমি আমাকে যত্ন ক’রে শেখাও না।
মেজবৌ বলিল, ঢের সময় লাগবে দিদি, তার চেয়ে বরঞ্চ আপনি অন্য সব বোনা শিখুন।
লক্ষ্মী মনে মনে রাগ করিল, কিন্তু তাহা গোপন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোমার শিখতে কত দিন লেগেছিল মেজবৌ ?
মেজবৌ জবাব দিল, আমাকে কেউ ত শেখায় নি দিদি, নিজের চেষ্টাতেই একটু একটু ক’রে—
লক্ষ্মী বলিল, তাইতেই। নইলে পরের কাছে শিখতে গেলে তোমারও সময়ের হিসাব থাক্তো।
মুখে সে যাহাই বলুক, মনে মনে নিঃসন্দেহে অনুভব করিতেছিল, মেধা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধিতে এই মেজবৌয়ের কাছে সে দাঁড়াইতেই পারে না। আজ তাহার শিক্ষার কাজ অগ্রসর হইল না এবং যথাসময়ের অনেক পূর্ব্বেই সূচ-সূতা-প্যাটার্ণ গুটাইয়া লইয়া বাড়ি চলিয়া গেল। পরদিন আসিল না এবং এই প্রথম প্রত্যহ আসায় তাহার ব্যাঘাত হইল।
দিন-চারেক পরে আবার এক দিন হরিলক্ষ্মী তাহার সূচ-সূতার বাক্স হাতে করিয়া এ বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। মেজবৌ তাহার ছেলেকে রামায়ণ হইতে ছবি দেখাইয়া দেখাইয়া গল্প বলিতেছিল, সসম্ভ্রমে উঠিয়া আসন পাতিয়া দিল। উদ্বিগ্ন-কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, দু-তিন দিন আসেন নি, আপনার শরীর ভাল ছিল না বুঝি?
লক্ষ্মী গম্ভীর হইয়া কহিল, না, এম্নি পাঁচ-ছ’ দিন আস্তে পারি নি।
মেজবৌ বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, পাঁচ-ছ’ দিন আসেন নি? তাই হবে বোধ হয়। কিন্তু আজ তা হ’লে দুঘন্টা বেশি থেকে কামাইটা পুষিয়ে নেওয়া চাই।
লক্ষ্মী বলিল, হুঁ। কিন্তু অসুখই যদি আমার ক’রে থাকতো মেজবৌ, তোমার ত এক বার খোঁজ করা উচিত ছিল।
মেজবৌ সলজ্জে বলিল, উচিত নিশ্চয়ই ছিল, কিন্ত সংসারের অসংখ্য রকমের কাজ—এক্লা মানুষ, কাকেই বা পাঠাই বলুন? কিন্তু অপরাধ হয়েছে, তা স্বীকার করচি দিদি।
লক্ষ্মী মনে মনে খুসী হইল। এ কয়দিন সে অত্যন্ত অভিমানবশেই আসিতে পারে নাই, অথচ অহর্নিশি যাই যাই করিয়াই তাহার দিন কাটিয়াছে। এই মেজবৌ ছাড়া শুধু গৃহে কেন, সমস্ত গ্রামের মধ্যেও আর কেহ নাই, যাহার সহিত সে মন খুলিয়া মিশিতে পারে। ছেলে নিজের মনে ছবি দেখিতেছিল। হরিলক্ষ্মী তাহাকে ডাকিয়া কহিল, নিখিল, কাছে এস ত বাবা? সে কাছে আসিলে লক্ষ্মী বাক্স খুলিয়া একগাছি সরু সোণার হার তাহার গলায় পরাইয়া দিয়া বলিল, যাও, খেলা কর গে।
মায়ের মুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল; সে জিজ্ঞাস করিল, আপনি কি ওটা দিলেন না কি?
লক্ষ্মী স্মিতমুখে জবাব দিল, দিলাম বই কি।
মেজবৌ কহিল, আপনি দিলেই বা ও নেবে কেন?
লক্ষ্মী অপ্রতিভ হইয়া উঠিল, কহিল, জ্যাঠাইমা কি একটা হার দিতে পারে না?
মেজবৌ বলিল, তা জানি নে দিদি, কিন্তু এ কথা নিশ্চয় জানি, মা হয়ে আমি নিতে দিতে পারি নে। নিখিল, ওটা খুলে তোমার জ্যাঠাইমাকে দিয়ে দাও। দিদি, আমরা গরীব, কিন্তু ভিখিরি নই। কোন একটা দামী জিনিস পাওয়া গেল বলেই দুহাত পেতে নেব, তা নিই নে।
লক্ষ্মী স্তুব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। আজও তাহার মনে হইতে লাগিল, পৃথিবী দ্বিধা হও!
যাবার সময়ে সে কহিল, কিন্তু এ কথা তোমার ভাশুরের কানে যাবে মেজবৌ।
মেজবৌ বলিল, তাঁর অনেক কথা আমার কানে আসে, আমার একটা কথা তাঁর কানে গেলে কান অপবিত্র হবে না।
লক্ষ্মী কহিল, বেশ, পরীক্ষা ক’রে দেখলেই হবে। একটু থামিয়া বলিল, আমাকে খামোকা অপমান করার দরকার ছিল না মেজবৌ। আমিও শাস্তি দিতে জানি।
মেজবৌ বলিল, এ আপনার রাগের কথা! নইলে আমি যে আপনাকে অপমান করি নি, শুধু আমার স্বামীকেই খামোকা অপমান করতে আপনাকে দিই নি-এ বোঝবার শিক্ষা আপনার আছে।
লক্ষ্মী কহিল, তা আছে, নেই শুধু তোমাদের পাড়াগেঁয়ে মেয়ের সঙ্গে কোঁদল করবার শিক্ষা।
মেজবৌ এই কটূক্তির জবাব দিল না চুপ করিয়া রহিল।
লক্ষ্মী চলিতে উদ্যত হইয়া বলিল, ওই হারটুকুর দাম যাই হোক, ছেলেটাকে স্নেহবশেই দিয়েছিলাম, তোমার স্বামীর দুঃখ দূর হবে ভেবে দিই নি। মেজবৌ, বড়লোকমাত্রেই গরীবকে শুধু অপমান ক’রে বেড়ায়, এই টুকুই কেবল শিখে রেখেচ, ভালবাসতেও যে পারে, এ তুমি শেখো নি! শেখা দরকার! তখন কিন্তু গিয়ে হাতে পায়ে পোড়ো না।
প্রত্যুত্তরে মেজবৌ শুধু একটু মুচকিয়া হাসিয়া বলিল, না দিদি, সে ভয় তোমাকে করতে হবে না।
৩ পরিচ্ছেদ
বন্যার চাপে মাটীর বাঁধ যখন ভাঙ্গিতে সুরু করে, তখন তাহার অকিঞ্চিৎকর আরম্ভ দেখিয়া মনে করাও যায় না যে, অবিশ্রান্ত জলপ্রবাহ এত অল্পকালমধ্যেই ভাঙনটাকে এমন ভয়াবহ, এমন সুবিশাল করিয়া তুলিবে। ঠিক এমনই হইল হরিলক্ষ্মীর! স্বামীর কাছে বিপিন ও তাহার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের কথাগুলা যখন তাহার সমাপ্ত হইল, তখন তাহার পরিণাম কল্পনা করিয়া সে নিজেই ভয় পাইল। মিথ্যা বলা তাহার স্বভাবও নহে, বলিতেও তাহার শিক্ষা ও মর্য্যাদায় বাধে, কিন্তু দুর্নিবার জলস্রোতের মত যে সকল বাক্য আপন ঝোঁকেই তাহার মুখ দিয়া ঠেলিয়া বাহির হইয়া আসিল, তাহার অনেকগুলিই যে সত্য নহে, তাহা নিজেই সে চিনিতে পারিল। অথচ তাহার গতিরোধ করাও যে তাহার সাধ্যের বাহিরে, ইহাও অনুভব করিতে লক্ষ্মীর বাকি রহিল না। শুধু একটা ব্যাপার সে ঠিক এতখানি জানিত না, সে তাহার স্বামীর স্বভাব। তাহা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনই প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং তেমনই বর্ব্বর। পীড়ন করিবার কোথায় যে সীমা, সে যেন তাহা জানেই না। আজ শিবচরণ আস্ফালন করিল না, সমস্তটা শুনিয়া কহিল, আচ্ছা, মাস-ছয়েক পরে দেখো। বছর ঘুরবে না, সে ঠিক।
অপমান লাঞ্ছনার জ্বালা হরিলক্ষ্মীর অন্তরে জ্বলিতেই ছিল, বিপিনের স্ত্রী ভালরূপে শাস্তি ভোগ করে, তাহা সে যথার্থই চাহিতেছিল, কিন্তু শিবচরণ বাহিরে চলিয়া গেলে তাহার মুখের এই সামান্য কয়েকটা কথা বার বার মনের মধ্যে আবৃত্তি করিয়া লক্ষ্মী মনের মধ্যে আর স্বস্তি পাইল না। কোথায় যেন কি একটা ভারি খারাপ হইল, এমনই তাহার বোধ হইতে লাগিল।
দিন-কয়েক পরে কি একটা কথার প্রসঙ্গে হরিলক্ষ্মী হাসিমুখে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিল, ওঁদের সম্বন্ধে কিছু করছ না কি?
কাদের সম্বন্ধে?
বিপিন ঠাকুরপোদের সম্বন্ধে?
শিবচরণ নিস্পৃহভাবে কহিল, কি-ই বা করব, আর কি-ই বা করতে পারি? আমি সামান্য ব্যক্তি বৈ ত না!
হরিলক্ষ্মী উদ্বিগ্ন হইয়া কহিল, এ কথার মানে?
শিবচরণ বলিল, মেজবৌমা ব’লে থাকেন কি না, রাজত্বটা ত আর বট্ঠাকুরের নয়—ইংরাজ গভর্মেণ্টের!
হরিলক্ষ্মী কহিল, বলেছে না কি? কিন্তু, আচ্ছা—
কি আচ্ছা?
স্ত্রী একটুখানি সন্দেহ প্রকাশ করিয়া বলিল, কিন্তু মেজবৌ ত ঠিক ও রকম কথা বড় একটা বলে না। ভয়ানক চালাক কি না! অনেকে আবার বাড়িয়েও হয় ত তোমার কাছে ব’লে যায়।
শিবচরণ কহিল, আশ্চর্য্য নয়। তবে কি না, কথাটা আমি নিজের কানেই শুনেছি।
হরিলক্ষ্মী বিশ্বাস করিতে পারিল না, কিন্তু তখনকার মত স্বামীর মনোরঞ্জনের নিমিত্ত সহসা কোপ প্রকাশ করিয়া বলিয়া উঠিল, বল কি গো, এত বড় অহঙ্কার! আমাকে না হয় যা খুসী বলেছে, কিন্তু ভাশুর ব’লে তোমার ত একটা সম্মান থাকা দরকার!
শিবচরণ বলিল, হিঁদুর ঘরে এই ত পাঁচ জনে মনে করে লেখাপড়া-জানা বিদ্বান মেয়েমানুষ কি না! তবে আমাকে অপমান ক’রে পার আছে, কিন্তু তোমাকে অপমান ক’রে কারও রক্ষে নাই। সদরে একটু জরুরি কাজ আছে, আমি চল্লাম। বলিয়া শিবচরণ বাহির হইয়া গেল। কথাটা যে রকম করিয়া হরিলক্ষ্মীর পাড়িবার ইচ্ছা ছিল, তাহা হইল না, বরঞ্চ উল্টা হইয়া গেল। স্বামী চলিয়া গেলে ইহাই তাহার পুনঃ পুনঃ মনে হইতে লাগিল।
সদরে গিয়া শিবচরণ বিপিনকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিল, পাঁচ-সাত বছর থেকে তোমাকে ব’লে আসচি, বিপিন, গোয়ালটা তোমার সরাও, শোবার ঘরে আমি আর টিক্তে পারি নে, কথাটায় কি তুমি কান দেবে না ঠিক করেছ?
বিপিন বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, কৈ আমি ত একবারও শুনি নি বড়দা?
শিবচরণ অবলীলাক্রমে কহিল, অন্ততঃ দশবার আমি নিজের মুখেই তোমাকে বলেছি। তোমার স্মরণ না থাক্লে ক্ষতি হয় না, কিন্তু এত বড় জমিদারী যাকে শাসন কর্তে হয় তার কথা ভুলে গেলে চলে না। সে যাই হোক্, তোমার আপনার ত একটা আক্কেল থাকা উচিত যে, পরের যায়গায় নিজের গোয়ালঘর রাখা কতদিন চলে? কালকেই ওটা সরিয়ে ফেল গে। আমার আর সুবিধে হবে না, তোমাকে শেষবারের মত জানিয়ে দিলাম।
বিপিনের মুখে এমনিই কথা বাহির হয় না, অকস্মাৎ এই পরম বিস্ময়কর প্রস্তাবের সম্মুখে সে একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িল। তাহার পিতামহর আমল হইতে যে গোয়ালঘরটাকে সে নিজেদের বলিয়া জানে, তাহা অপরের, এত বড় মিথ্যা উক্তির সে একটা প্রতিবাদ পর্য্যন্ত করিতে পারিল না, নীরবে বাড়ি ফিরিয়া আসিল।
তাহার স্ত্রী সমস্ত বিবরণ শুনিয়া কহিল, কিন্তু রাজার আদালত খোলা আছে ত!
বিপিন চুপ করিয়া রহিল। সে যত ভাল মানুষই হোক, এ কথা সে জানিত, ইংরাজ রাজার আদালতগৃহের বৃহৎ দ্বার যত উন্মুক্তই থাক্, দরিদ্রের প্রবেশ করিবার পথ এতটুকু খোলা নাই। হইলও তাহাই। পরদিন বড়বাবুর লোক আসিয়া প্রাচীন ও জীর্ণ গো-শালা ভাঙ্গিয়া লম্বা প্রাচীর টানিয়া দিল। বিপিন থানায় গিয়া খবর দিয়া আসিল, কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে, শিবচরণের পুরাতন ইটের নূতন প্রাচীর যতক্ষণ না সম্পূর্ণ হইল, ততক্ষণ পর্য্যন্ত একটা রাঙা পাগড়ীও ইহার নিকটে আসিল না। বিপিনের স্ত্রী হাতের চুড়ি বেচিয়া আদালতে নালিশ করিল, কিন্তু তাহাতে শুধু গহনাটাই গেল, আর কিছু হইল না।
বিপিনের পিসিমা সম্পর্কীয়া এক জন শুভানুধ্যায়িনী এই বিপদে হরিলক্ষ্মীর কাছে গিয়া পড়িতে বিপিনের স্ত্রীকে পরামর্শ দিয়াছিলেন, তাহাতে সে নাকি জবাব দিয়াছিল, বাঘের কাছে হাত যোড় ক’রে দাঁড়িয়ে আর লাভ কি পিসিমা? প্রাণ যা যাবার তা যাবে, কেবল অপমানটাই উপরি পাওনা হবে।
এই কথা হরিলক্ষ্মীর কানে আসিয়া পৌঁছিলে, সে চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু একটা উত্তর দিবার চেষ্টা পর্য্যন্ত করিল না।
পশ্চিম হইতে ফিরিয়া অবধি শরীর তাহার কোন দিনই সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল না, এই ঘটনার মাস-খানেকের মধ্যে সে আবার জ্বরে পড়িল। কিছুকাল গ্রামেই চিকিৎসা চলিল, কিন্তু ফল যখন হইল না, তখন ডাক্তারের উপদেশমত পুনরায় তাঁহাকে বিদেশ- যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইতে হইল।
নানাবিধ কাজের তাড়ায় এবার শিবচরণ সঙ্গে যাইতে পারিল না, দেশেই রহিল। যাবার সময় সে স্বামীকে একটা কথা বলিবার জন্য মনে মনে ছট্ফট্ করিতে লাগিল, কিন্তু মুখ ফুটিয়া কোনমতেই সে এই লোকটির সম্মুখে সে কথা উচ্চারণ করিতে পারিল না। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, এ অনুরোধ বৃথা, ইহার অর্থ সে বুঝিবে না।
—০—
সমাপ্ত
Be the first to post a comment.