আমি কুত্তা বলছি… (একটি কুকুর এর আত্মকাহিনী)
আমি কুত্তা বলছি…
কুক্কুর হস্তি বান্দরম যায় না যার যার মুখকর্মন।
আমি ছাড়া আরও দুইটি প্রানির সহিত তুলনা করা হইয়াছে। কিন্তু ইহাদের মধ্যে আর কেহই নেই যাহারা তোমাদের সঙ্গে এত ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। আমার গায়ের রং কালো আর সাদা মিশ্রিত। জন্ম আমার ঢেকিশালে, মাতৃ দুগ্ধ সেবন শেষে মা যখন খাদ্য অন্বেষণে বাহির হইত তখন আমার ভাতৃ কুলের সহিত কলহ করিয়া সময় অতিবাহিত করিতাম। সেই থেকে আমার কলহ প্রিয়তা জন্ম হইয়াছিল, যাহা আমি আজন্ম লালন করিতেছি। স্বজাতি দেখিলেই সেই আজন্ম লালিত কলহ প্রিয়তা উদ্রেগ হয়, যাহা আমি কোন ভাবেই সংবরণ করিতে পারিনা।
জন্মের তিন মাস পর আমি মাতৃ হারা হইলাম। পিতৃ খোজ আমি কোন দিনই পাই নাই। মাতৃ পিতৃ হারা পথের কুত্তা। আমি পথে পথে খাদ্য সন্ধানে ঘুরি, এমতবস্তায় একজন স্বহৃদয়বান ব্যক্তির দর্শনে তাহার পশ্চাদানুসরণে ব্রতি হয়। বাড়িতে পৌছা মাত্র তাহার ছোট কন্যাটি আমাকে আদর করিতে থাকে, জন্ম অবধি যাহা পাই নাই। সেই স্নেহ ধন্য আদর আমাকে হৃদয় আপ্লুত অশ্রু ধারা রোধ করার ক্ষমতাকে বাধ ভাঙ্গিয়া দিল। আদর যত্ন শেষে আমাকে উদর পূর্তির ব্যবস্থা হইল। হে মোর দেশ মাতৃকা আমার মত চতুষ্পদ বক্র লেজের বিশিষ্ট একটা প্রাণীর এমন যন্ত, আদর, স্নেহ মমতা দিতে পারে তাহা আমি এই জীবনে প্রথম জানিলাম। মেয়ে আদ আদ সুরে তার বাবাকে বলিল – বাবা আমি এর নাম দিলাম টম, সেই থেকে আমি টম নামে পরিচিত।
প্রথম প্রথম যেই বাড়িতে আসে, আমি তাহাকে আমার ভাষায় স্বাগত জানাই। অনেকেই ভয় পায়, আবার অনেকেই বুঝিয়া বলে এই বাবা চুপ্ কর। তোমরা জান বাবা বলার কারন স্পষ্ট, আমিতো তোমাদের মত কাপড় পরিধান কারনা। ধীরে ধীরে আমি পূর্ণ বয়স্ক হইলাম আমি এখন চারিদিকের বাস্তব অবস্তা বুঝিতে সক্ষম হইয়াছি। মানুষের দর্শন মাত্র তাহার মনের অবস্তা অনেকটায় বুঝিতে পারি, যাহার কারণে আমি এখন ঐ বাড়ির সমস্ত কিছুর পাহারা দ্বারে পরিনত হইয়াছি।
দিন সমান নাহি যায়। আমি বুঝতে পারছিলাম চারিদিকে পরিস্থিতি যেন পরিবর্তন হইতেছে। আমার গৃহ কর্তার মানষিক অবস্থারত্ত স্পষ্ট পরিবর্তন দেখিছিলাম। নানা লোকের নানা গুঞ্জন আমি লক্ষ করিতেছিলাম। তোমরাতো জান আমি তোমাদের ভাষা বুঝিনা ঠিকই তবে তোমাদের আচার আচরণ বুঝি। আমি তোমাদের থেকে শব্দও বেশী শুনিতে পাই। তোমরা অন্ধকারে যাহা দেখিতে পাওনা আমি কিন্তু অবলীলাক্রমে তাহা দেখতে পাই।
যাহা হোক আমি যাহা বলিতেছিলাম, সে সময় মানুষের আনা-গোনা কানা-ঘুষার পরিমান বেশি দেখতেছিলাম। চারিদিকের লোকজন দলে দলে অন্য কোথাও যেন চলিয়া যাইতেছিল। একদিন রাত্রে আমার মনিব তাহার বাড়ির লোক জন সহ আরও বেশ কয়টি পরিবার টোপলা-টুপলি লইয়া অন্যত্র যাওয়ার ব্যাবস্থা করিল। আমিও তাহাদের সহযাত্রী হইলাম। আমার মনিব আমাকে রাখিয়া যাওয়ার জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা লইল। আমি কিন্তু তাহার কথা কর্ণপাত করিলাম না।
প্রথমে আমরা একটি নদী পার হইলাম। মাথা বাদে আমার সমস্থ শরীর ভিজিয়াগেল। গরম কাল অর্থাৎ চৈত্র মাস, তাই আমার কোন অসুবিধা হইল না। তারপর উঠিলাম একটা পতিত বাড়িতে। সেখান থেকে আমার মনিবরা সবাই ঘোড়ার গাড়ী যোগে যাইতে লাগিল আর তাহাদের পিছে পিছে দৌড়াইতে লাগিলাম। বেশ খানিক ক্ষণ যাওয়ার পর দেখিলাম আমাদের গাড়ীর বহরের প্রথম গাড়ীটা কিছু লোকজন দ্বারা আক্রান্ত হইল। আমাদের সব গাড়ীই সেখানে দাঁড়াইয়া গেল। আমি সেখানে যাহা দেখিলাম, তাহা কলহ প্রিয় কুকুর জাতির কাছে বলিলেও কেহ বিশ্বাস করিত না।
মানুষের সমস্ত অধিকার ভুলুন্ঠিত করিয়া সমস্ত কিছুই কাড়িয়া লইল। আমার মনিবকে তাহারা মার-ধর করিল। ছোট মেয়েটি তাহার বাবার জন্য অত্যন্ত কান্না-কাটি করিতেছিল। এটা আমার সহ্য সিমার বাহিরে যাইতেছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারতেছিলাম না। সমস্ত কিছু নেওয়ার পর আমাদের ছাড়িয়া দিল। ভগ্ন হৃদয়ে আমরা আবার যাত্রা আরম্ভ করিলাম। বেশ পথ যাওয়ার পর রাত্রি অবসান হইল। কি যেন কিসের ভয়ে আমরা সবাই একটু আড়াল স্থানে অবস্থান করিতেছিলাম। সারাদিন অতি বাহিত হইল কিন্তু রন্ধন ব্যবস্থা অনুপস্থিত। শিশুরা ক্ষুদায় কান্না কাটি করিতেছিল।
আমি সমস্ত কিছুর নিরব দর্শক হইয়াছি মাত্র। সারা দিন পর একজন ব্যাক্তি কিছু ছোলা-গমের ছাতু এবং গুড় দান করিল। সেই যৎসামান্ন খাদ্য দিয়া খুদা নিবৃত হইল। ছোট মেয়েটির উৎসৃষ্ট খাদ্য আমার সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা হইল। রাত্রি বেশ হইল। কয়েক জন নতুন লোক যোগ হইল আমাদের সঙ্গে। তাহারা পথ চেনে হয়তো বা। যাত্রা তব শুরু হইল। সারা রাত্রি হাঁটা হইল। কোথাও বা বন মধ্যে, কোথাও বা জন শুন্য মাঠ দিয়ে।
যাহা বলিতেছিলাম, চৈত্র-বৈশাখ মাস তাই ছোট খাট বিল ঝিল মনে হইতেচ্ছিল সুদুর তেপান্তর। প্রথমত রাত্রি অন্ধকার মনে হলেও রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর সবই সহজ সরল মনে হইতেছিল। আমার দৃষ্টিতে রাত দিন সবই সমান। যাহাই হোক সারা রাত্রি হাঁটার পর প্রভাতে পাখী ডাকা আরম্ভ হইল। রাত্রি অবসানের সংকেত ধ্বনী মনে হয় আমরা পেয়ে গেলাম। দূর দূরন্তে কোথাও হইতে আজানের ধ্বনী মহান শ্রষ্টার সৃষ্টির একাংশকে জাগ্রত করিতে চলিয়াছেন। নতুন লোকগুলি আমাদের সবাইকে এক পাট ক্ষেতের মাঝে রাখিয়া চলিয়া গেলেন। আমাদের সবাই দুই দিন অনাহারে থাকার পর একজনের কাছে থাকা কিছু চাল ডাল দিয়ে খিঁচুড়ি রান্নার ব্যবস্থা হইল। কিন্তু বাঁধ সাধিলো ধুয়া যা লুকানো ছিল আমাদের জন্য অসম্ভব।
দূর থেকে ফেলিলো অনেকেই। বেশ কিছু লোকজনও জমা হইল আমাদের আস্থানায়। কেউ ভয় দেখাইতে লাগিল কেউ বা দিলো সাহস। সেই ভিড়ের মধ্যে মুখ ভর্তি দাড়ি, টুপি মাথায় এক পৌড় বাক্তি, সাম্ভবত তিনিই ঐ গ্রামের মোড়ল, বলিলেন, “তোমরা যে যাহাই বল আমি তাহাদের সাথেই থাকিব। যদি কোন খাঁন সেনারা বা অন্য কোন বাহিনী আসে, জীবন দিতে হলেও দিব, তবুও ছাড়িয়া যাইব না, এই অসহায় মানুষদের থেকে।” যাহাই হোক সেই কাথা শুনিয়া অন্য সবাই চলিয়া গেল। তিনি সারাদিন আমাদের সহিত থাকিলেন।
দিনের পর আবার রাত্রি আসিল, ঐ বৃদ্ধের নির্দেশে চারজন বাক্তি আমাদের সহযাত্রি হইলেন। যাত্রা শুরু হইল রাত নয়টার পর। আমরা একই পথ বারবার ঘুরিয়া ফিরিয়া যাইতেছিলাম। তোমরা না বুঝলেও আমি ভালোভাবে বুঝি কারণ কিছুদূর যাওয়ার পর আমি ঠিকানা দিয়া যাইতেছিলাম। এটা আমাদের জন্মগত স্বভাব। আমরা যাইতেছিলাম কখনও পানি, কখনও বাগান, কখনও পতিত বাড়ির পাশ দিয়া।
এক সময়ের ঘটনা আমাকে খুবই নাড়া দেয়। আমরা যাইতেছিলাম এক বাড়ির পাশ দিয়া সমানে রাস্তা টহল দিতেছিলো পাকিস্থানি আর্মি। আমি কিন্তু নির্বিগ্নে শুনিতে পাইতেছিলাম তাহাদের বুটের শব্দ যাহা সহযাত্রিরা শুনিতেছিল না। বাড়ির ভিতর থেকে আমার এক স্বজাতি আমাকে আক্রমণাত্বক সুরে ডাকিয়া উঠিল। প্রতিবাদ জানাইলাম আমি। নিশ্চিত বিপদ বুঝিয়া আমার মনিব আমার পায়ে জড়াইয়া ধরিল, চুপ থাকিতে বলিল আমাকে। আমি লজ্জাই, অপমানে, ক্ষোভে মুচড়ে পড়িলাম। যিনি আমাকে রাস্তা থেকে তুলিয়া আনিয়া এই নবজীবনের স্বাদ দিয়াছেন, সেই তিনিই আমার পায়ে ধরিলেন! চুপ করে গেলাম একে বারে। যাই হোক অতি কষ্টে বহু বাধা বিপত্তির উপেক্ষা করিয়া আমরা ভারতে পৌছাইলাম।
কপালের লিখন না যায় খন্ডন। সেখানে থাকা খাওয়ার যে ব্যবস্থা তাহা নেহাতই জীবন বাঁচানোর জন্য। আমি ঐ ধরনের জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলাম না। তাই আমাকে কয়েক দিনের মধ্যই আমাকে ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইতে হইল। ফিরিয়াও আসিলাম আমার দেওয়া ঠিকানা অনুসারে। রিক্ত শূন্য মনিব এর ভিটাই আমি দিনাতিপাত করি। অপেক্ষা করছিতেলাম আমার মনিব ফিরিয়া আসিবার জন্য। আমার শরীরও খারাপ হইয়া যাইতেছিল।
এই দুঃসময়ে তোমরা যাহারা মানুষ তোমাদের স্বজনরা পাশে থাকে, সেবা-যত্ন করে কিন্তু বিধাতার বৈরী মনোভাবে আমাদের সেই সৌভাগ্য হয় না। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকি তাদের মনুষত্বের দিকে। তাও আমার ভাগ্যে জুটিলো না কারন আমার মনিব এখানে নাই। জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল যিনি আমাকে অমূল্য জীবন রক্ষা করিয়াছেন অন্তত তাহার দিকে তাকিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করিব। ইশ্বরকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই, দীর্ঘ নয় মাস পর আমার আরাধ্য মনিব আমার নিকট আসিলেন, মাথায় হাত বুলালেন। কী যে এক পরম শান্তি, কী যে এক আনন্দ, কী যে এক অনুভূতি যা বলার সাধ্য আমার নাই। আমার জন্মভূমিতে মাথা রাখিয়া, স্বজনের পরম স্নেহে ঘুমাইতে যাইতেছি। আমি কুকুর তাই আমার কাছে আমার দেশ এত মধুর আর তোমরা মানুষ, না জানি তোমাদের কাছে এই দেশ কত মধুর…
লেখক__
গৌর পদ ঘোষ
সহকারী শিক্ষক
বিষয়খালী এস, এম, স্কুল এন্ড কলেজ
বিষয়খালী, খড়িখালী, ঝিনাইদাহ।
০১৭১৬৫২২৩২৪
গল্পটি অনেক ভাল লেগেছে।
স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর সাহিত্য কর্ম আমাদেরকে উপহার দেওয়ার জন্য।
অনেক সুন্দর একটি গল্প স্যার। খুব ভাল লেগেছে আমার কাছে।
স্যার আমার জন্ম ১৯৮৬ সালে।
১৯৭১ সালের ঘটনা চোখে দেখিনি শুধু দাদা-দাদির মুখ থেকে শুনেছি। কিন্তু এই গল্পটা পড়ছিলাম আর মনে হল আমার চোখের সামনে ভাসছে এই কাহিনী/ ঘটনা গুলো।
this is a very heart touching story.
ধন্যবাদ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি সামনে ভাসছে গল্পটি পড়ে।
অনেক সুন্দর একটি গল্প করলাম অনেক দিন পর।
অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার কে
ভাই নিঃসন্দেহে আপনি একজন বড় ধরনের সাহিত্যিক । এমন সুন্দর সাহিত্যকর্ম আপনাকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখবে।
অনেক ধন্যবাদ ভাই আপনাকে।